I first interviewed Bitan Chakraborty back in 2015, prior to the release of his much acclaimed collection of short stories, Santiram-er Cha. The interview was then published at Dhaka Review. The journal has shut down and the piece is lost. Straight Bat comes handy as I approach the old charm.

‘আলোতে মানুষকে অবয়ব মনে হয়, আমি দেখেছি’—বিতান চক্রবর্তী

প্রসিদ্ধ নাট্যনির্দেশক সুপ্রীতি মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত জঙ্গমে দীর্ঘ আট বছর থিয়েটারের প্রশিক্ষণ। আর সেই থেকে অল্পবিস্তর লেখালিখির শখ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইনফরমেশন টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করা যুবকটি কোনোদিনও শান্ত মনে একটা চাকরি করে উঠতে পারেনি। দু-তিনটি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প সময়ের জন্যে চাকরি করেছেন ঠিকই, তবে সে দাসত্বের বান্দা হয়ে থাকতে নারাজ। পারিবারিক আনুকূল্য ছিল, এ কথা যেমন মুক্তকন্ঠে বলা যায় না, আবার বিরোধিতা পেয়েছেন পরিবার পরিজন থেকে, এমন কথাও অত্যুক্তি হবে। সব মিলিয়ে তার পরিবার নিউট্রাল থেকে গেছেন; আর শিল্পী মাত্রেই জানেন, প্রকৃত নিরপেক্ষ ব্যাপারটি অনেকটা সোনার পাথরবাটির মতো। প্রথম বই “অভিনেতার জার্নাল”। প্রকাশকাল ২০১৩। আর ২০১৬-র সূচনায় ওঁর “শান্তিরামের চা” বইটি প্রকাশ পেতে চলেছে। সাতটি ছোটগল্পের সংকলন। প্রকাশক শাম্ভবী। বিচ্ছিন্নভাবে বিতান চক্রবর্তীর লেখা প্রকাশিত হয়েছে রবি (খবর ৩৬৫ দিন), সমাকল্য, নন্দন (বাংলাদেশ), বাউন্ডুলে, প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায়। কিন্তু ধারাবাহিকতার সুদূরে যে লেখকের বাস, তাকে পাঠকমহলে পরিচিত করাবার দায়িত্ব খুশি মনে তুলে নিলাম আজ।

প্রশ্ন অভিনেতাদের ক্ষেত্রে এমন হয়েই থাকে। যেমন অবোধের মাধুরীকে আমরা মনে রাখিনি, অথচ তেজাবের মাধুরীকে আমরা আজও মনে রেখেছি। সেটা এক-দো-তিন গানটির জন্য হোক, বা ওঁর অভিনয়ের জন্য হোক। অভিনেতার জার্নাল-এর গ্রন্থকার বিতান চক্রবর্তীকে পাঠক মনে রেখেছে বলে মনে হয় না আমার। শান্তিরামের চা-এ পাঠক তোকে মনে রাখবে মনে হয়?

উত্তর লেখকদের ক্ষেত্রেও এমন হয়। আর এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, যতক্ষন আমি লিখছি লেখাটা আমার, লেখা হয়ে গেলে তা পাঠকের। আর পাঠক কাকে নেবে বা মনে রাখবে তার হিসেব আজও করা সম্ভব হয় না। আমি জানি, আমি যখন এই বইটি লিখেছি তখন কোনো ছলনা করিনি। তাই এই বই আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আর মনে রাখারাখি সেটা পাঠক আর সময়ের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

প্রশ্ন এ-তো পাশ কাটিয়ে উত্তর দেওয়া, বিতান। তোর শান্তিরামের চা-এ সেই ধক নেই? লেখকের আত্মবিশ্বাস বলে তো একটা কথা আছে নাকি?

উত্তর ধক! লেখা তো আর আদা নয়, যে ধক থাকবে। দ্যাখো, বিশ্বাস আমার আছে। তবে সেটা চিন্তার। আর যখন বই হয়, তখন সেটা আর শুধু চিন্তা থাকে না। তা হয়ে ওঠে চিন্তা পেরিয়ে দৃষ্টি। দেখার জোর সৃষ্টিতে বেশ বড়ো জোর, আমি বিশ্বাস করি। আমি আমার জানলা দিয়ে যা দেখি তাই আমার কাছে দৃষ্টি। তার মানে কি এই এটাই কেবল দৃষ্টি, আর কিছু নেই? নিশ্চয়ই আছে। সেটা না হলে রবীন্দ্রনাথের পরই সব লেখা থেমে যেত। এমন হয়নি কিন্তু। আমাদের দেখার জোর আরও বেড়ে গেছে। তাই না? তাই আমি সময়ের দিকেই তাকাতে চাই কেবল। দেখা যাক আমার দৃষ্টি কতদূর গেল!

প্রশ্ন বেশ। এখানেও উত্তর পেলাম না। শুনতে চেয়েছিলাম, হ্যাঁ, আমার লেখা পাঠক মনে রাখবে। আমি এমন উত্তরকে দুঃসাহস বলি না। বলি, আত্মপ্রত্যয়। পাঠক মনে রাখবে কি মনে রাখবে না সেটা সময়ের হাতে অবশ্যই। তবু জোর গলায় বলাই যায়। তুই সম্ভবত মৃদু উচ্চারণের পক্ষপাতী। তোর গল্পেও তাই। ঠিক কিনা!

উত্তর মৃদু উচ্চারণ কিনা জানি না। তবে আমি উচ্চস্বর পছন্দ করি না। এতে কেবল গলার জোরই বোঝা যায়, আর কিছু নয়। দ্যাখো, এই বই একটা সমাজ, পৃথিবী কিছুই হয়তো পালটাতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, পাঠককে ভাবাবে। আমি কেবল এটুকুই চাই। ভাবনাই একটা সময়কে পালটায়, এ আমার বিশ্বাস। আমার গল্পের সমস্ত চরিত্রই তা বিশ্বাস করে। কারণ, জোর করে কিছু রাখা যায় না, আমি দেখেছি। সবটাই নিঃশব্দে অর্জন করতে হয়। আমিও করেছি। যেটুকু পাওয়ার কথা এটুকু সময়ে।

প্রশ্ন “অভিনেতার জার্নাল” একটি গদ্যের বই। আর দু-বছরের কিছু বেশি সময় পর একটি ছোটগল্পের সংকলন। গদ্য থেকে গল্প এই রাস্তায় হাঁটলি কেন?

উত্তর আসলে আমি গল্পই লিখতাম। “অভিনেতার জার্নাল” লেখাটা শুরু হয় যখন আমি থিয়েটার করতাম। তখন আমাদের রোজ রিহার্সাল-এর ডায়েরি লিখতে হত। লিখতাম। সে সময় হঠাৎ একদিন আবেশ (বন্ধু) বলল ও তপন সিংহ সংখ্যা করছে আর আমার কাছে অন্যরকম কিছু একটা লেখা চায়। আমি ভাবতে বসলাম কী লিখি। সিনেমা নিয়ে লিখিনি কখনও। রিহার্সালের ডায়েরিগুলো দেখতে দেখতেই হঠাৎ এই “অভিনেতার জার্নাল” গদ্যটা মাথায় আসে। শুরু করে দিলাম। তারপর কিছু পত্রিকার জন্যও তৈরি করলাম থিয়েটার নিয়ে ওই লেখাগুলো। এরপরই মনে হল এই লেখাগুলোর একটা সংকলন করলে কেমন হয়। করে ফেললাম। এই আরকী!

প্রশ্ন ছোটগল্প লিখেছিস, ভালো কাজ নিঃসন্দেহে। গল্পকার হিসেবে কোন লেখককে বা লেখকদেরকে তুই সামনের সারিতে দেখিস? কাদের লেখা তোকে উৎসাহিত করে, অনুপ্রাণিত করে বেশি করে?

উত্তর শরৎবাবু। তারপর সত্যজিৎ। শরৎ-এর ন্যারেশন আমাকে পাগল করে দেয়। সত্যজিৎ অসম্ভব ক্যালকুলেটিভ। গোছানো। আইডিয়া কী মারাত্মক! রসবোধে শীর্ষেন্দু, হুমায়ুন আহমেদ। বিদেশি গল্পকার মপাশা আমাকে উৎসাহ দেন “হন্তারক” গল্পটা লিখতে। আর অবশ্যই সুনীল, সৎ লেখার জন্য। আর একজনের কথা বলব। রাসকিন বন্ড। ওনার চোখ আর সহজতা আমার ভালো লাগে।

প্রশ্ন “আলোতে মানুষকে অবয়ব মনে হয়, আমি দেখেছি”। আবার, “প্ল্যাটফর্মের কালো রাস্তাটা ঘাসে ঘাসে ভরে গেছে। ডিসেম্বরের এই শীতেও গাছগুলো ভরে আছে লাল-নীল ফুলে। রাস্তার দু-পাশের গোমড়া দোকানগুলো আজ আইসক্রিম পার্লারে বদলে গেছে”। তোর গল্পে এবং গদ্যে কবিতার এক সহজাত অবস্থান। কবিতার লাইন থেকে গল্পে, বা গদ্যের লাইনে আছড়ে পড়িস বারবার। একবার, দু-বার নয়, বারবার। কেন এমন হয় তোর?

উত্তর আমার মেলামেশা কবিদের সঙ্গেই বেশি। তাদের লাইন, মৃদু মৃদু রোম্যান্টিকতা আমাকে খানিক খানিক চালনা করেছে একসময়। তাই ভাবগুলো অমন কাব্য হয়ে গেছে। আর এই দৃশ্যগুলো আমারই সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা। এমন আমারই সঙ্গে ঘটেছে কত। আর একটা কথা বলি, ভারতে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই একটা কাব্যময়তা আছে। হয়তো ভাব আন্দোলনই আমাদের দিয়েছে এই রস। কত সাধারণ মানুষকে বলতে শুনেছি কত কাব্যিক কথা। যেমন ধরো, বোগেনভিলিয়াতে নকুলদা বলেন, “জীবনে তো কত কিছুই আমাদেরকে কাঁটা দেয়, তা বলে কি সে সবকিছুকেই আমরা কেটে ফেলি।” এ আমার নিজের কানে শোনা সংলাপ।

প্রশ্ন আজকাল দেখছি আয়তনে ছোটো গল্পকে ছোটগল্প নামে ডাকে লোকজন। লেখক, পাঠক, দুই-ই। কিন্তু অন্তরের অতৃপ্তি, আরও খানিক পাওয়ার ইচ্ছেটা গল্পের থেকে উধাও। ছোটগল্প লেখার নামে কী হচ্ছে, খোঁজখবর রাখিস কিছু?

উত্তর রাখি। এ নিয়ে আমার তেমন কিছু বলার নেই। পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে চিরকালই। চলুক। আমি পারি না অত অল্প পরিসরে কিছু লিখতে। আমার বড়ো পরিসর লাগে। তবে হ্যাঁ, পাঠক কিন্তু আজও সেই বড়ো পরিসরেই গল্প পড়তে ভালোবাসেন। আমি দেখেছি মানুষ অণুগল্প তেমন পড়েন না। দেখবে, স্বপ্নময়বাবু ছাড়া আর কারও অণুগল্প সংকলন তেমন চলেনি বাজারে।

প্রশ্ন টানা আট বছর জঙ্গমে। থিয়েটার দেখা, শেখা, শেখার চেষ্টা করে যাওয়া তোর অভিনেতা সত্তা পুষ্ট করেছে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু লেখক বিতানকে সমৃদ্ধ করেছে কি কোনোভাবে?

উত্তর থিয়েটার অনেকটা হেল্প করেছে। ওখানেই শিখেছি একটা চরিত্রকে কেমনভাবে গড়তে হয়। শিখেছি, ডায়লগ লেখা। চরিত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করা। আর, প্রচুর গল্প পড়েছি একসময়ে। আমি যখন ছোটো ছিলাম দুপুরে ঘুমোতাম না। ঘুরে ঘুরে আমার কিছু কল্পনায় তৈরি করে নেওয়া চরিত্রের সঙ্গে খেলা করতাম। ঠাকুমা একদিন বিরক্ত হয়ে বললেন, ওই দ্যাখ, তাকে যে বইগুলো আছে ওখানে অনেক কমিকস আছে, পড়। ওই শুরু করলাম। বইগুলো দেশ (শারদ সংখ্যা)। তখন সত্যজিৎ-এর ফেলুদা বেরোতো। সেই যে নেশা ধরল। আজও ছাড়ল না আমায়।

প্রশ্ন “অভিনেতার জার্নাল” কেন জানি অসম্পূর্ণ মনে হয় আমার। নির্বাচিত অংশবিশেষ আমি অনুবাদ করেছি। সেটা প্রকাশিতও হয়েছে একটি প্রচলিত ইংরেজি সাহিত্য পত্রিকায়। মনে হয়, বইটিতে তোর আরও অনেক কিছু দেওয়ার ছিল। সময়াভাব অথবা কোনো কারণে সেটা করে উঠতে পারিসনি বলেই বোধ হয়। ইচ্ছে হয় না বইটিকে নতুনভাবে আরও একবার সাজাতে? আই মিন, রিডুয়িং ইওর ওল্ড বুক?

উত্তর ইচ্ছে আছে। এপ্রিলে করব। নতুনভাবে। হয়তো নতুন অংশ জুড়ব। আসলে, আমাদের বাংলা সাহিত্যে এডিটিং বলে তেমন কিছুর প্রচলন নেই। তারই অভাব আছে বইটাতে। কেন জানি না আমাদের লেখকরা মনে করেন তারা যেটা লিখেছেন সেটাই চূড়ান্ত। তার এডিটিং কে করবে, কার এত বড়ো সাহস! যার প্রভাব বই বিক্রিতেও পড়ে। তুমি তো ইংরেজিতে লেখো, তুমি এটা বুঝবে, এডিটিং একটি লেখাকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যায়!

প্রশ্ন লেখালিখির বাইরে একটা প্রশ্ন করি। লেখক হিসেবে আমার মনে হয়, প্রকাশক এবং লেখক যখন একটি কাজে একাত্ম হতে পারেন, তখনই একটি বই প্রকাশ সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে ওঠে। পাঠকের কাছে পৌঁছোনো সহজতর হয়। কিন্তু প্রকাশক যখন নিজেই লেখক তখন? একাত্ম হওয়াটা সহজ হয়? আরে ভাই, লেখকের তো মস্ত ইগো। তোকে এই প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য, হাওয়াকল প্রকাশনার কর্ণধার তুই নিজে।

উত্তর খুব সুবিধে হয় যখন প্রকাশক ও লেখক দুজনে একসঙ্গে মিলে কাজ করেন। তাতে বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। কিন্তু মুশকিল কী জানো, ইগো প্রবলেম! এমন অনেক পাণ্ডুলিপি থাকে যাতে প্রচুর এডিটিং দরকার হয়, কিন্তু ওই যে ইগো! আমাদের তখন কাজ করতে হয় দোকানের মতো। ছেপে দিই। আর তারপর যখন বইটি লোকে তুলেও দেখে না তখন প্রকাশক দোষী। খালি বলে, প্রচার করো। আরে বাবা, সে না হয় করব, কিন্তু দ্যাখো, আমি একজনকে বইটা দিলাম, বললাম কিছু লিখে দেবেন বইটা নিয়ে? তিনি পড়ে চুপচাপ, আবার জিঞ্জেস করলাম লিখবেন না? তিনি রেগে বললেন, কী সব কাজ করছিস তুই? আমি এ বই নিজের টেবিলেও রাখব না। বিশদে জানতে চাইলাম, ধরে ধরে দেখালেন কোথায় কোথায় দুর্বলতা। লেখককে বললাম, তিনি উত্তর দিলেন, কে উনি?

প্রশ্ন শেষে একটাই প্রশ্ন। তোর প্রতিটি গল্পের প্রোটাগনিস্ট একজন পুরুষ। এমন কেন? একাধিক নারী সঙ্গ, যৌনতা এসব স্বাভাবিকভাবেই এসেছে তোর জীবনে। কখনও একটি মেয়ে হয়ে গল্প বলার ইচ্ছে হয় না? মূল চরিত্রে একজন নারী হলে তো পাঠকেরাও ধন্য ধন্য করবেন। জনপ্রিয়তার এত সহজ ফর্মুলা সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলি?

উত্তর সহজে জনপ্রিয় হতে বলছ? না, তা করিনি। তাই বলে এড়িয়েও যাইনি ইচ্ছে করে। আমি তো আমার সত্তা দিয়ে দেখি। আর আমি পুরুষ বলে আমার বেদনা, আনন্দ, অনুভূতি কম, নারীদেরই বেশি, এ আমি মানি না। আমি মানুষের বেদনার কথা, সুখের কথা, আনন্দ-বিষাদের কথা বলতে চাই। এতে আমি জনপ্রিয় হতে না পারলে হব না। কী করা যাবে? আর যারা সহজ ফর্মুলায় যেতে চায় যাক।

*সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয় জাহেদ সরওয়ার সম্পাদিত ঢাকা রিভিউ-তে (ডিসেম্বর, ২০১৫)